সিঙ্গাপুর টু ঢাকাঃ ভালবাসা উড়োজাহাজে উড়ে উড়ে যায়

সিঙ্গাপুরে চিকিতসা শেষে আসরাফ সাহেব ফিরে যাচ্ছেন দেশের মাটিতে। অনেকদিনের চিরচেনা প্রকৃতিকে ছেড়ে সিঙ্গাপুরের দিনগুলো তার মোটেও ভাল লাগে নি। সিঙ্গাপুরের প্রাচুর্য্য আর জৌলুস তাকে একটুও ছুয়ে যায় নি, তবে মনে নাড়া দিয়ে গেছে ঠিক। অস্র হাতে দেশ স্বাধীন করেছেন ঠিকই কিন্তু সে হাত শক্ত হয়ে দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে দাঁড়ানোর আগেই দেশটার কোমর ভেঙ্গে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে স্বার্থান্বেষিরা- আসরাফ সাহেব ভাবেন আর নিজের সাথে কথা বলেন- “বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের তুলনায় সিঙ্গাপুর ছিল নগন্ন, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়কালও কাছাকাছি। তাদের একজন লি কুয়ান ইউ থাকলে আমাদের ছিল শেখ মুজিব। শুধু আমাদের ছিল না সহি বুঝ, সবাই নিজের আখের গুছাতে ব্যস্ত”
সিঙ্গাপুরের সময়গুলো আসরাফ সাহেব আর তার পরিবারকে পাক্কা গাইডের মত সবকিছু চিনিয়ে দিয়েছে তার ছোট মেয়ে মৃদুলা। যেন সে অনেক এসেছে সিঙ্গাপুরে। অবশ্য ইন্টারনেট বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মূঠোয় তাই এখন অচেনা বলতে কোন দেশ নেই, অজানা বলতে পৃথিবীতে কোন জায়গা নেই। তবে মৃদুলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ব্লগ এবং অন্যান্য স্যোসাল মিডিয়াতে মৃদুলার সরব উপস্থিতি। তার পছন্দের কয়েকজন ব্লগারের মাঝে একজন “ভাগ্যান্বেষী”। তবে তার সঠিক পরিচয় মৃদুলা্র অজানা, আগ্রহও ছিল না। গতানুগতিক লেখার বাইরে তথ্যবহুল বিশেষত সিঙ্গাপুর নিয়ে অসংখ্য তথ্যবহুল পোষ্ট দিত “ভাগ্যান্বেষী” যা অনেক সাংবাদিকও পত্রিকার নিজ নামেই মেরে দিত। কিছু কিছু পোষ্ট এত প্রনবন্ত লাগত মৃদুলার কাছে যে পোস্টগুলো পরে ভুলেই যেত পাঠক বাংলাদেশে, যেন  “ভাগ্যান্বেষী” সাথে সাথে তারাও বেড়াচ্ছে কখন মেরিনা বে, কখনও বা সিঙ্গাপুর রিভার, সাইলসো বিচ বা ক্যাপেল বে’র তীর ঘেষে; রাতের আলোকছটায় মোহনীয় সিঙ্গাপুর প্রানের স্পন্দনে যোগ করছে ভিন্ন মাত্রা। “ভাগ্যান্বেষী”র পোস্টগুলো শেয়ার করত “স্বপ্নের সিঙ্গাপুর” ফেসবুক পেজটি। এ পেজের বিভিন্ন পোস্টের লেখার ধরনও “ভাগ্যান্বেষী”র মত। মৃদুলা “ভাগ্যান্বেষী”র পোস্ট গুলোর সত্যতা যাচাই করতে “স্বপ্নের সিঙ্গাপুর” ফেসবুক পেজের এডিমিন আসিফকে মেসেজ করত, রিপ্লাইও পেত সাথে সাথে। কথোপতথন চলতে থাকত আর এভাবে সিঙ্গাপুরের জীবন যাপন, হাসি কান্না তাকে ছুয়ে যেতে থাকল। “ভাগ্যান্বেষী”র সাথেও ক্ষুদে বার্তা চালাচালি হত অন্যান্য পছন্দের ব্লগারের মতই। সাপ্তাহিক ব্লগাড্ডায় “ভাগ্যান্বেষী”র পক্ষ নেয়া মৃদুলা তার প্রতি বিশেষ টান অনুভব করে। অদেখা “ভাগ্যান্বেষী”র তা অজানা আর জানলেও তার তাতে বিন্দু মাত্র ভ্রুখেপ নাই, এত দিনেও মৃদুলা “ভাগ্যান্বেষী”র আসল নামটাই জানতে পারে নি। ততদিনে আসিফ মৃদুলার ভাল বন্ধু বনে যায়।
হঠাত যখন অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের পথে, দুঃখের এদিনে প্রতিটি ক্ষেত্রে মৃদুলাকে অদৃশ্য ভাবে সাহায্য করছে ভাগ্যান্বেষী, আসিফ বা অন্যরা। তাদের মেলে ধরা অভিজ্ঞতার তথ্য ভান্ডার  থেকে তথ্য নিয়ে মৃদুলা দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে বিদেশ বিভুয়ে তার পরিবারকে। মৃদুলা দেশে যেয়ে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা শেয়ারের পাশাপাশি ব্লগিং এর শুফল এবং “ভাগ্যান্বেষী”কে ধন্যবাদ দিয়ে সিঙ্গাপুরের দিনলিপি নামে সিরিজ ব্লগ লিখবে। আসিফের সাথে দেখা করার কথা চিন্তা করেও হয়নি। হয়তো  ভাগ্যান্বেষী’র প্রতি টান থেকেই। ফিরে যাচ্ছে মৃদুলা ও তার পরিবার। ব্যবসা সঙ্ক্রান্ত জটিলতায় মৃদুলার ভাই আসতে পারে নি। ভাবি তৃনা, মা আর বাবা কে নিয়ে মৃদুলা বিমানে। দু’চার বছরের বড় তৃনা আর মৃদুলা বন্ধুভাবাপন্ন। তৃনা দু সিট পিছনে; মা বাবা আর ম্রিদুলা এক সাথে। সিটে বসতে যেয়ে মৃদুলার ভাবি থমকে যায়। পাশের লোকটা তার বেশ পরিচিত, এক সময়ের সহপাঠী বা তার চেয়ে বেশী কিছু। তৃনা এক সময় এ ছেলেটাকে ভালবাসত, কিন্তু ধনীর কন্যা তৃনা’র প্রতি বাস্তববাদী এ ছেলেটার কোন আগ্রহই ছিল না, হাসিমুখেই সেদিন তৃনার প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়েছিল এ । তৃনা অসুন্দর তা নয় বরং বৈষয়িক চিন্তাই ছেলাটাকে তৃনা থেকে দূরে রাখে যা মৃদুলার অজানা নয়। সিট বদল করে বিরিক্তির ছাপ মৃদুলা বসল সেই লোকটির পাশে। জানালার পাশে আরেক জন বিমান ছাড়ার আগেই চাদর মুড়ি দিয়ে বসা যার সাথে “ভাগ্যান্বেষী” একটা পোস্টের আবুল ভাইরের বেজায় মিল।  একটু পর সিদ্ধ টাওয়েল দিয়ে যাচ্ছে বিমানবালা, জানালার পাশে বসা লোকাটা ততখনে ঘুমের ভান করে আছে। তৃনার পরিচিত লোক টাওয়েল নিয়ে জানালার পাশে বসা লোককে বলছে ভাই খাবেন। মৃদুলা তাতে হি হি করে হেসে দিল সেই আবুল ভাইয়ের কথা মনে করে যে টাওয়েলকে রোল মনে করে কামড়ে দিয়েছিল। মৃদুলার বিরক্তির ভাবটা যেন কমে আসছে। মৃদুলার ইচ্ছা ছিল জানালার পাশে বসে উড়োজাহাজের পাখায় পাখা মেলে মেঘের সাথে ভেসে বেড়াতে, সফেদ মেঘ মাঝে মাঝে মৃদুলাকে আলতো করে ছূয়ে যাবে আবার মেঘের ফাক দিয়ে উকি দেওয়া সুর্যরশ্মির ঝলকে ঝলমলিয়ে উঠবে আশপাশ। বাবা মার সাথে বসলে হয়ত জানালার পাশেই বসতে পারত , আকাশের মেঘের পাল্কির সাথে ভেসে বেড়াত বিমানের ডানায় ভর করে, পাখিদের বলত –
       আমি ডানাহীন পাখি,
       আয় আখি মেলে থাকি।

তাতে পাশে বসা লোকটার উপর রাগ আবার বেড়ে গেল। জানালার পাশে বসা লোকটা ইতিমধ্যে ২-৩ বার বাথরুমের পথে। মৃদুলার বিরক্তি যেন তাতে অনেকাংশে বর্ধিত হল। পাশের লোক এবার মৃদুলাকে জানালার পাশে বসতে বললে সায় দিল না অন্যের সিটে বসতে। এবার লোকটি বুঝিয়ে বলল জানালার পাশে তার বসার কথা,  মৃদুলা মাঝখানে আর যে জানালার পাশে বসছে তার সিট আসলে রাস্তার পাশে। জানালার পাশে বসা লোক মানতে নারাজ, অগ্যতা টিকিট চেক করে সিটের সাথে মিলিয়ে দেখে তার ভুল ভাঙ্গাল। মৃদুলার ধন্যবাদান্তে লোকটা নিরব। উড়োজাহাজ চলছে স্বগর্বে স্বদেশে, স্বভুমের পথে। সামনের দিকের আর এক লোক টয়লেটে যাবার পথে মৃদুলাদের সিটের কাছে থামল। আগেও কয়েকজন থেমেছে কিন্তু কিছুই বলে নি। অপরিচিত লোকগুল এখানে থামছে কেন? মৃদুলা বুঝতে পারল তারা আসলে থামছে তৃনার পরিচিত লোকটাকে দেখে। এক ভদ্রলোক বলতে শুরু করল, “ভাই আপনি দেশে যাচ্ছেন তা ফেসবুক দেখেই বুজছি, কিন্তু এ ফ্লাইটেই যাচ্ছেন তা জানতাম না। দেখে ভাল লাগল, দেশে যেয়ে বাসায় বেড়াতে আসবেন কিন্তু”
পাশের লোক , “ আমারও ভাল লাগছে”
এবার আরও একজন, “আরে আসিফ ভাই না? আজকে আপনার ছবি পোস্ট না করলে তো অচেনাই থেকে যেতেন। ভাই আপনার পেজ থেকে কিন্তু অনেক দরকারি তথ্য পাই। ব্যস্ততার মাঝে আমাদের সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ, এখন তো ফলোয়ার ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে তাই না”
পাশের লোক , “হুমম।। আপনাদেরও ধন্যবাদ”
মৃদুলা এবার হকচকিত। ব্যস্ততায় ফেসবুকে চোখ বুলানো হয়নি আজ। এ কি “স্বপ্নের সিঙ্গাপুর” পেজের এডিমিন আসিফ। মৃদুলা না হয় আসিফকে চিনে না । কিন্তু আসিফ তো ম্রিদুলাকে চিনে তাহলে কথা বলল না কেন? অবশ্য এত এত ফলয়ারের অনেক অনেক ভাল বন্ধু থাকতে পারে যা অনলাইনেই। মৃদুলা ভাবছে কিন্তু কথা বলবে কিনা তা বুঝতে পারছে না।
এবার মৃদুলা , “ আপনি কি স্বপ্নের সিঙ্গা...
আসিফ, “হমম”
মৃদুলা, “আমাকে চিনতে পারছেন”
আসিফ, “না চিনার তো কোন কারন দেখিনা”
ম্রিদুলা , “কিছু বললেন না যে”
আসিফ, “চেহারায় অমন রুদ্রমুর্তি দেখে তার ঘারে কয়াটা মাথা যে কথা বলতে যাবে। তার উপর তৃনার কান কথা”
কথা এগিয়ে চল্লল অনেক ক্ষন...
ভিইপি যাত্রীদের একজন ঢু মারছে এদিকে । কাছে দিয়ে যেতেই মৃদুলা চিনতে পারল তিনি আর কেউ নন, প্রিয় মাহাবুব ভাই। সাংবাদিক, জনপ্রিয় ব্লগার আবার মানুষকে অনুপ্রেরনা দানেও পটু। মৃদুলার সাথে পরিচয় ব্লগিংএ। মাহাবুব ভাই দু’চার টা গুরুগম্ভীর কথা চালান দিয়ে পিছিনের দিকে চলে গেল। ততক্ষনে আসিফ টয়লেট থেকে সিটে এসে বসেছে। মাহাবুব ভাই ফেরত যাচ্ছেন, মৃদুলা হাসি মুখে আর এবার ইশারায় কথা বিনিময়। এবার মাহাবুব ভাই, “ ওহে ভাগ্যান্বেষী, অন্বেষন কিন খান্ত হল না কি বিরতি নিচ্ছ?” মৃদুলার যেন মাথা ঘুরছে। কাকে ভাগ্যান্বেষী বলছে মাহাবুব ভাই? আসিফ বিদেশে কাজ করে বলে তাকে ভাগ্যান্বেষী বলছে নাকি অন্য কাউকে। নাকি ব্লগার ভাগ্যান্বেষী? আসিফ এবার ঘার ঘূরিয়ে তাকাতেই দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করছে।

মাহাবুব ভাই, “নাম না এবার বদলাও। বাবা মা’র দেওয়া নাম টাই অসুন্দর কোন দিকে? অফিসে জম্পেস আড্ডা হবে এবার। মাহমুদ, তূর্জ, সার্জা, ত্রিভুজও আসবে” আসিফ হাসছে কিন্তু কিছুই বলছে না। মৃদুলার বুঝেতে বাকি রইল আসিফ আর ব্লগার ভাগ্যান্বেষী একই ব্যক্তি। ভাললাগা যেন চারিপাশ থেকে উরে উরে আসছে আর জাপ্টে ধরছে মৃদুলাকে। মন চাইছে বিমানের গতির হ্রাস টেনে ধরতে। ৪ ঘন্টার পথে ১ ঘন্টা বাকি। আসিফে আটকে আছে মৃদুলার আখি। বলাকার বিহঙ্গমন অস্থিরতায় দিকবিদিক, মৃদুলার উচ্ছাস আসিফ টের পাচ্ছিল কিন্তু তা অপ্রকাশিত অথবা তার মুখায়বই এমন। মৃদুলা হৃদয় নিংরানো কথার ফুলঝুড়ি বকুলের গন্ধশোভিত হয়ে আসিফের মন ছূয়ে যাচ্ছে। চারিপাশের মানুষের কথার আওয়াজ যেন নিক্কন। অনেক কথাই অব্যক্ত আবার অনেক অব্যক্ত কথা অনুধাবিত হল অপলক দৃষ্টিতে। শুধু অব্যক্ত থেকে যাচ্ছে মৃদুলার অন্তরে স্বযত্নে লালিত ভালবাসার কথা, উচ্ছ্বাসে প্রকাশের ভাষা হারিয়েছে তবে তা যে মুখে বলা না বলার নামান্তরই। এতোক্ষনে আসিফের সববুঝতে পারার কথা। আসিফ কি মৃদুলার ভালবাসায় গাত্রদাহন করবে? আসিফ বরাবরের মতই হাসোজ্জল, সে হাসির অর্থ মৃদুলাদের বুঝা বড় দায়।    

No comments

Theme images by merrymoonmary. Powered by Blogger.