কল্পনায় অকল্পনীয় কল্পকথা : প্রবাস জীবনের ইতিকথা
১৬ই ডিসেম্বর ২০২১, ২১ বছর সিঙ্গাপুরে প্রবাসজীবনের ইতি
ঘঠিয়ে মকবুল সাহেব ঢাকার উদ্দশ্যে। বিমানের আতিথিয়ত্যা সেই আগের মতই কুড়ি বছর মাঝে
পেরিয়ে গেলেও তাদের আপ্যায়নের (!) কোন পরিবর্তিন হয়নি। ভাবতে ভাবতে মকবুল অজান্তেই
ফিরে গেল ২১ বছর আগের এমনি এক দিনে যেদিন পথে পথে মলিন মুখে চোখের ইশারায় বিদায়
দিয়েছিল, পরিবার শুদ্ধ লোক তাকে বিদায়
দিতে জড়ো হয়েছিল তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। আজ কি আবার সবাই জড়ো হবে
তাকে নতুন করে গ্রহন করতে, নবজন্মা শিশুর মত সে কি আমন্ত্রিত হবে? তা তো হবার নয়,
এ বিশ বছরে অনেক পরিজনের ঠাই হয়েছে শেষ আলয়ে আবার নতুন অনেকের আগমনে কোলাহলিত
হচ্ছে বাড়িঘর।
অবশেষে নির্ধারিত সময়ের ১ ঘন্টা পরে বিমান শাহজালাল বিমান
বন্দরে অবতরন করল। পুলিশি আপ্যায়ন, মালামাল নিয়ে বের হতে আরও ১ ঘন্টার উপর চলে
গেল, সেই সাথে একটি ব্যাগ খোয়া যাবার খবরটাও পেল। মকবুল তাতে মোটেই অবাক হল না, ২১
বছরের কয়েকবার ই এমন হয়েছে।
মকবুলকে শেষ বারের মত বিমানবন্দর থেকে নিতে বরাবরের মতই তার
বাবা একাই এসেছে, কল্পনাগুলো অলীকেই কল্পানাতীতের মত বাক্সবন্দি করে গাড়িতে চাপল।
পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন ঘঠেছে, ঘঠেছে বাংলাদেশেরও পরিবর্তন। মকবুলের মতে সবচেয়ে
পরিবর্তন ঘঠেছে সিংঙ্গাপুরের, জীবনের অর্ধেক টা কাটিয়ে , যৌবনের পুরোটা ঠেলে
মকবুলের মত অসংখ্য মকবুল সাজিয়ে দিয়ে গেছে লায়ন সিটি সিঙ্গাপুরকে। গাড়ীতে যেতে
যেতে মনে পরছে ঝোপঝাড়, মাঠ গুলোতে এখন সুপার লিফট সম্বলিত ৪০ তলা দালান, অটো মেটিক
কার পার্ক, বৃষ্টি প্রতিরোধে অদৃশ্য ছাতা, রোবট গুলো ঘুরছে ফিরছে হুকুমের অপেক্ষায়
সাহায্য করবে বলে। প্রযুক্তির সাথে মানবজীবনের অপুর্ব মেল বন্ধন সিঙ্গাপুরের
জীবনকে নিয়ে গেছে ভিন্ন এক জগতে, যেন পৃথিবীর বাইরে ভিন্ন এক জগতে। গাড়ী এগিয়ে
চলছে, কখনো জ্যামে থামছে, কখনো বাতাসে দুর্ঘন্ধের ঝাপ্টা আছড়ে পরছে নাকে, গাড়ির
হর্নের শব্দে মকবুলের মাথা ধরে কিন্তু শব্দ এতই বেশি যে আজ ধরছে না।
গাড়ি ছলছে বিজয় দিবসের ভীড় ঠেলে। যদিও অবস্থা দেখে মকবুলের
বিজয় দিবস আর ভালবাসা দিবসের পার্থ্যক বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। আবার বিজয় উদযাপান নিয়ে
দু’ গ্রুপের ধাওয়া পালটা ধাওয়াও চোখ এড়াল না। এবার মকবুকের বাবা কথা শুরু করল, সেই
পুরোন দিন যেদিন তাকে প্রথম বিদায় তে এসেছিল...
এক পর্যায়ে মকবুলের বাবা তুলে আনল মকবুলের ছেলে মইদুলের
কথা। মইদুল নাম বদলে রেখেছে ম্যাক। ডি জে ম্যাক। ছেলেকে নিয়ে আসার জন্য মকবুলের বাবা
অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু নেশায় বুদ হয়ে থাকা ম্যাক বাবা বলতে ইয়াবা কেই বুঝে। বউ
ব্যস্ত হিন্দি সিরিয়াল, রুপচর্চা নিয়ে, মকবুল সেখানে বুড়ো ভাম, বড় বেমানান। মেয়ে
মডেলিং এর নামে কি করছে তার খবর কেউ রাখে না। যাদের সুখের আশায় জীবন যৌবন বিসর্জন
দিল আজ তার এ কোন সুখের অসুখে ভুগছে।
এ শহরে অনেক
পরিবর্তন, শুধু পরিবর্তন নেই ট্রাফিক সিস্টেমের অথচ মন্ত্রী আছে, আমলা আছে;
মন্ত্রনালয়, কর্মী সবই আছে। ট্রাফিক সিস্টেমের কথা ভাবতে ভাবতেই উলটো দিক থেকে আসা
একটি ট্রাকের আঘাতে উলটে গেল মকবুলের গাড়ি। প্রবাস জীবনের হিসাব নিকাশের পুরোটাই
বাকি। দেশে ফিরে আসার আনন্দের সাথে বিজয় দিবসের আনন্দ একাকার হয়ে যাবার বদলে যেন
ঘোর অন্ধকার নেমে আসল। মকবুলের চিৎকারে কয়েজন তাকে জাপ্টে ধরল। সম্ভিত ফিরে পেয়ে
মকবুল দেখল সে এখনো সিঙ্গাপুরেই। অনেক আগে চাঙ্গি বিমানবন্দরে চলে এসেছিল, লাউঞ্জে
বিশ্রামের সময় চোখের পাতা কখন লেগে গেছে তা টেরই পায় নি , আর তাতেই কল্পনার রাজ্য
ভীড় জমায় নানা প্রশ্ন নিয়ে।
অবশেষে সময় হল বিমানে চড়ার, নির্ধারিত সময়ের আগেই বিমানে
যাত্রী বসানো হচ্ছে। ২১ বছর প্রবাসের শ্রম আর রেমিটেন্সের কৃতজ্ঞতা স্বরুপ সিঙ্গাপুরস্থ
বাংলাদেশ হাই-কমিশনের বিশেষ শুভেচ্ছে পত্র আর প্রীতি উপহার পাইলট নিজ হাতে পৌছে
দিল মকবুলকে। করতালিতে মুখরিত হল বিমান, মকবুলের মন ভরে উঠল, তা নাই বা দেখল
প্রাচুর্যের সিঙ্গাপুর, কিন্তু এ পাপ্তি যেন প্রাচুর্যের চেয়েও বেশি কিছু । বাংলাদেশে
বিমানের সেবার মান বেড়ে গেছে শতগুনে তা মকবুল ভেতরে ঢুকেই হারে হারে টের পারছে।
সেই কবে সে বিমানে চড়েছে তা নিজেও মনে করতে পারছে না। সেই সাথে বেড়েছে যাত্রীদের
সচেতনতা, এখন আর তাদের মাঝে তাড়াহুড়া নেই, নেই বিমানবালাদের নির্দেশানবলি না মানার
প্রবনতাও।
নির্ধারিত সময়ে বিমান পৌছাল শাহজালাল বিমানবন্দরে,
ইমিগ্রেশনে অটোমেটিক ক্লিয়ারেস্ন সিস্টেম আবার প্রবাসীদের জন্য আলাদা লাইন লিখা
দেখে মকবুল অবাক না হয়ে পারল না। মুহুর্তেই কাজ শেষ করে ব্যাগেজ পেতেও সময় লাগল
না, মন যেন চাঙ্গি এয়ারপোর্টেই ঘুরপাক
খাচ্ছে। যদিও চাঙ্গির তুলনা সে নিজেই, সেবার মানে অতুলনীয়। ইমিগ্রেশনে সেলফ
সার্ভিস, ব্যাগেজ খালাসে বেল্টের বদলে অটোমেটিক ট্রলিতে যার যার মালপত্র আলাদা
করাই।
ইমিগ্রেশন পর্ব শেষে মকবুল পেল আরোও এক সুসংবাদ।
প্রবাসীকল্যান মন্ত্রনালয় থেকে বিশেষ সনদ আর পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির মন্ত্রনালয়ের
কর্মী, মকবুলের মত শত শত মকবুল পাচ্ছে এ কার্ড। এ কার্ড ব্যবহার করে অনেক কিছুতেই
ছাড় পাবে, পাবে ডিস্কাউন্ট। প্রবাসীরা এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা,
রেমিটেন্সেরযোদ্ধারা এতটুকু সুবিধা পেতেই পারে।
বিমানবন্দরের বাইরেই অপেক্ষমান তার পরিবার পরিজন, সবাই
দলবেধে আসবেই বা না কেন, মেট্রোরেল ভ্রমনকে করেছে সহজতর, উড়াল সড়ক তাতে দিয়েছে
ভিন্ন মাত্র। ঢাকার জ্যাম এখন যেন গল্প উপন্যাসের পরিহাস।
টিং, টিং , টি টি টি টি টি... শব্দে মকবুল হকচকিত,
মেট্রোরেলের শব্দ অবিকল সিঙ্গাপুরের মত, তবে কি বাংলাদেশের চেয়ে সিঙ্গাপুরের প্রতি
তার বেশি মায়াজন্মে গেছে। সবকিছুতে কেন সিঙ্গাপুরকে খুজে ফিরছে, জীবন যেন
সিঙ্গাপুরময়।
সম্ভিত ফিরে পেয়ে মকবুলের ভেতরটা দুমরে মুচড়ে উঠল, শব্দটা
আসলেই সিঙ্গাপুরের মেট্রোরেলের। মকবুল সিঙ্গাপুরের ট্রেনেই ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল,
বাংলাদেশের বিমানবন্দর, ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, হাই কমিশন আর প্রবাস মন্ত্রনালয়ের
সব কিছু শুধুই অলীক কল্পনা। প্রবাসফেরত এক লোকের আত্নহত্যা, ঢাকায় রোড এক্সিডেন্টে
১৫ জন গুরুতর আহত, মালশিয়াতে প্রবাসীদের দুর্দশার খবর পরতে পরতে কখন যে ঘুমিয়ে পরে
ছিল তার স্বপ্ন দেখা শুরু করল তা টেরই পায়নি বেচারা মকবুল। বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক
দিক গুল বাস্তবের মুখ দেখবেকিনা কেউ জানে না, তবে সিঙ্গাপুর নিয়ে ইতিবাচক দিক গুল
যে ভালভাবেই বাস্তবের রুপ নেবে তা জানে মকবুল, জানে জানবে সারাবিশ্ব।
No comments