স্মৃতির মেরিন টেকনোলজিতে স্বপ্ন - দুঃস্বপ্ন
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি - হাজারো প্রতিভা তাদের লাখো স্বপ্ন নিয়ে বছরের পর বছর পাড়ি জমাচ্ছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে. অনেক স্বপ্নের অকালমৃত্যু হচ্ছে ১ম বছরেরই, অনেক স্বপ্ন সফেদ হয়ে যায় পড়াশোনার গন্ডি শেষ করেই আবার অনেকে স্বপ্ন দেখাই ছেড়ে দেয়. স্বপ্ন দেখানোর কারিগররাই যেখানে স্বপ্নদেখানোর রাস্তা খুঁজে পায় না অথবা খোজার চেষ্টাও করে না সেখানে ভর্তি হওয়া প্রতিভাগুলোর স্বপ্ন নিজের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে হত্যা করাটাই স্বাভাবিক. আবার হাতে গুনা যে কয়জন নিজেদের চেষ্টা আর বিধাতার দৈবশক্তিতে স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বা গেছেন তারাও পিছনে তাকায়না পাছে তাদের সিড়িতে প্রতিযোগী চলে আসে অথবা অজানা কোন কারণে. অথচ স্বপ্নের আলোক বর্তিকা হাত বদল হলে এত দিনে চারদিক আলোঝলমলে এতটাই ঝিলমল করত যে অন্য যে কোন আলো এ আলোকে পথ ছেড়ে দিয়ে বাধ্য থাকত. আর সেই আলোর ফাল্গুধারায় অবগাহন করে নতুন আগত প্রতিভাগুলো দ্বিগুনবেগে আলোকচ্বটার বিচ্ছুরন ঘটাত.
যে পরিমান প্রতিভা প্রতিবছর প্রতিভা মৃত্যুর এ কারখানায় ঢুকছে, তাদের সঠিক পরিচর্যা করা গেলে মেরিন টেকনোলজি নামক বটবৃক্ষ এতদিনে মহীরুহে পরিনত হবার কথা. বাস্তবে তার থেকে অনেক দুরেই আছি আমরা বা আমাদের মেরিন টেকনোলজি.
যদিও মেরিন কালচার, মেরিন ট্রেডিশন বা সিনিয়র জুনিয়র রিলেশন নামক অনেক কঠিন থিওরি প্রতিটা প্রাক্তন বা বর্তমান ছাত্রই শুনে থাকার কথা কিন্তু বাস্তবের চিত্র আসলে তত্ত্বকথায় সীমাবদ্ধ নেই বা তত্ত্বকথার প্রয়োগিগ দিকটা অন্তসার শুন্য. (আমার উপলব্ধি)
মেরিন যাত্রার সূত্রপাত
ছাত্রহিসেবে ছিলাম ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের. এসএসসি ২০০২ তে নারায়ানগঞ্জ জেলার মেরিট লিস্টের একদম উপরের দিকেই নাম ছিল. সে হিসেবে ব্যবসায় শিক্ষাই হওয়া কথা ভবিষ্যতের পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু. স্কুলজীবনের প্রতিযোগীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেই মেরিন টেকনোলজিতে পদার্পনের সূত্রপাত. তখন মেরিন টেকনোলজিতে ভর্তি হতে ভর্তি পরীক্ষাতে অংশগ্রহণ করতে হত. ভর্তিপরীক্ষার বিষয়গুলোর মাঝে সাধারণজ্ঞান ছাড়া বাকিসবই বিজ্ঞান বিভাগের মানে আমার আওতার বাইরের. তার মাঝে পরীক্ষার্থী আসবে সারাদেশ থেকে. ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেয়ে শুনতে পেলাম শিক্ষকদের কেউ কেউ ভর্তি পরীক্ষার জন্য টিওশন করান, পূর্ববর্তী বছরগুলোর প্রশ্নপত্র দেন আর তাদের ব্যাচের ছাত্ররাই সুযোগ পায়. তাহলে আমার জায়গা কোথায়. প্রথম ২০ জনে ঠাই পাবার সম্ভাবনা যে ক্ষীন. যাই হোক রেজাল্ট দেখে উল্টোটাই মনে হলে, আমারও ঠাই হলো লিস্টে.
ভর্তি বিরম্বনা
মেরিননে ক্লাস শুরু হবে ২০০৩তে , ততদিনে আমি আমার প্রিয় বিষয় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে HSC তে ভর্তি হয়ে যাই. এসএসসি'র মূল সনদ কলেজে জমা রাখে. এদিকে মেরিনে ভর্তি হতে মূল সনদ লাগবে এবং আমাকে সময় বেধে দেওয়া হয় যেন সনদ জমা দিয়ে ভর্তি হই. এদিকে কলেজ এ সময়ের ভেতর এসএস সি'র মূল সনদ দিতে অপারগ. মেরিনের রেজিস্টারের উচ্চগলার স্বর যেন কানে বাজতে থাকে. সে সময় আমার এক পরিচত মেরিনের ছাত্র আমাকে নিয়ে যায় "জ" অদ্যাক্ষরের ডিপ্লোমা ৩য বর্ষের এক ভাইয়ের কাছে ডিপার্টমেন্ট হেড কে সুপারিশ করে সনদ জমাদেবার সময় বর্ধিত করার জন্য. "জ" নিয়ে যায় "জি: নামক আর এক ভাইয়ের কাছে. "জি" আমাকে নিয়ে যায় ডিপার্টমেন্ট হেড এর কাছে এবং তাদের মাঝে কথাবার্তা শেষ হলে "জি" আমার কাছে ৫০০০ টাকা দাবি করে, আর না দেবারও কোন কারণ বা পথ খোলা ছিল না সেদিন. এটাকি ঘুষ নাকি, মেরিনের সিনিয়র- জুনিয়র রিলেশনশিপের দর্শন, নাকি মেরিন কালচার সে প্রশ্ন মাঝে মাঝেই মনে উকি দিত, এখনো দেয়না যে তা না.
স্বপ্নের ঘোর থেকে বাস্তবতায়
সেদিন মনেহয় ১ম থিওরি ক্লাস, ইসরাজুল স্যার হাসতে হাসতে অবলীলায় বলে চললেন " বাবারা, তোমরা কি ভাবতেছ জানি না. হয়ত ভাবতেছ মেরিন ইন্জিনার হবা , ভাব নিয়ে চলবা ; আসলে কিন্তু ভিন্ন , তোমরা হবা গ্রীজার". বাসার কাছেই ডক-ইয়ার্ড , গ্রীজার কি জিনিস তা বুঝতে পারাই স্বাভাবিক. ভাবতে লাগলাম তাহলে পড়াশোনা কেন ? অন্যদের এটা শুনে কি উপলব্ধি হয়েছিল জানিনা কিন্তু আবার ভেতরে ভিন্ন কিছু খেলে গেল. এবার দেশে যেয়ে ইসরাজুল স্যারকে খুঁজে ফিরেছিলাম এটা বলার জন্য " স্যার আমি গ্রীজার হইনি একদিনের জন্যও". তবে এর মানে এই না যে গ্রীজার জবকে আমি তাচ্ছিল্য করছি. উনি এটাকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন সহজেই. সবাই তো আর ১ম জবেই ম্যানেজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে না.
সিনিয়রিটি - সালাম ট্রেডিশন
দুর্ব্যবহার বিষয়টা আমার বড্ড অপছন্দনীয়. একদিন সেই "জি" অদ্যাখরের সিনিয়র ভাই তার সাথে দেখা করতে বললেন. অগ্যতা সেই রিলেশনশিপ ত্বত্তের খাতিরে তার রুমে গেলাম. রুমের ভেতরেই সবার জুতা রাখা, সবগুলো টেবিলেই বইপুস্তকে ভরপুর, শোবার বিছানাগুলো অগোছালো. সেই ভাইকে দেখলাম না রুমে. শুধু একজন গিটারে সুর তোলার আপ্রাণ চেষ্টায় নিমজ্জিত. তাকে বিরক্তকরার কোন কারণ পেলাম না এবং দাড়িয়েই রইলাম. তার ইশারায় অদুরেই চেয়ারে বসলাম. গিটারের শব্দ থামতেই তার অকথ্য ভাষা আর উচ্চধবনি তার বাজানো বেসুরে গিটারের সুরকে কয়েকশত গুন বেশি বিরক্তি করমনে হলো. আর আচরণ .... সেদিন সেই "রু" অদ্যাক্ষরের ভাইয়ের দুর্ব্যবহার কারণ ছিল - আমি জুতা পরে ঘরে ঢুকছি (যদিও সে নিজেই জুতা পরে কক্ষের ঠিক মাঝখানে বসে ছিল) এবং তাকে সালাম দেই নি (বেসুরে গানের মাতাল সমুদ্রে বিভোর অবস্থায় সালাম প্রত্যাশী) . হায়রে মেরিনের সালাম ট্রেডিশন.
মেজরিটি - মাইনরিটি
লোকাল বয় হিসেবে হোস্টেলে না থাকারই কথা. সেশন জট দূর করতে আমাদের কাল্স হত বিকেলে , শেষে হতে হতে সন্ধ্যা. তখন বাংলাদেশের ক্রিকেট ভিন্ন পর্যায়ে যাচ্ছে মাত্র. আশরাফুল , মাশরাফি আর আফতাব' রা আলো চরাচ্ছিল দেশ বিদেশে. খেলাদেখার নেশা আমাদের মাঝেও ছিল . "মেজরিটি - মাইনরিটি থিওরি" নামক কিছুএকটার উদয় হলো. কিভাবে কি হলো বা কার মস্তিস্কপ্রসূত বুদ্ধি তা এখনো অজানা. ক্লাস শুরুর আগে কতজন ক্লাসকরতে চায় আর কত জন চায় না তা নির্ণয় করে সংখ্যাধিক্কার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হতে থাকলো. একসময় কোনকারণ ছাড়াই এ "মেজরিটি - মাইনরিটি থিওরি"র প্রয়োগ হতে থাকলো. আর তার ভুক্তভোগী ছিলাম লোকাল বয় এই আমি. সারা পথ পাড়ি দিয়ে এসে দেখি মেজরিটি ক্লাস করছে না মানে ক্লাস হবে না. "মেজরিটি - মাইনরিটি থিওরি"তে স্যারদেরও খুশি হতেই দেখা যেত. স্যারদের কাল্সনা করানো আর স্বপ্ননা দেখানোর মাঝে কোন ফারাক আছে কি? দু'একজন সহপাঠি যারা কাল্স করতে চাইত , লোকাল বয় হিসেবে আমাকে যে প্রতিবাদ করতে বলে নি তা কিন্তু নয়.
চলছে চলবে ......
No comments